ভালোবাসার ফাঁদ: হানি ট্র্যাপ ও আধুনিক গোয়েন্দা কৌশল
২০২৩ সালের মে মাসে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার (DRDO) শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী প্রদীপ কুলকার্নিকে মুম্বাই থেকে গ্রেফতার করে মহারাষ্ট্র অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াড (ATS)। এই খবরে অনেকেই স্তম্ভিত হন। কারণ DRDO এমন একটি সংস্থা, যারা ভারতের সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তাদের কাছে সংরক্ষিত থাকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য।
প্রদীপের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নথি পাচার করেছিলেন। আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই গোয়েন্দা কৌশলে ব্যবহার করা হয়েছিল এক সুন্দরী নারীর ফাঁদ—অর্থাৎ, তিনি হানি ট্র্যাপের শিকার হয়েছিলেন।
হানি ট্র্যাপ কী?
‘হানি ট্র্যাপ’ বলতে বোঝায় এমন একটি ফাঁদ, যেখানে টাকার লোভ বা হুমকি কাজে না আসলে, টার্গেটকে প্রলোভনের মাধ্যমে কামনার জালে ফেলা হয়। এখানে মূলত প্রেম বা যৌন সম্পর্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় এই কৌশলে ব্যবহৃত হয় আকর্ষণীয় নারী বা পুরুষ, যারা পরিকল্পিতভাবে লক্ষ্য ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং গোপন তথ্য আদায় করে নেয়।

প্রদীপ কুলকার্নি এমনই এক ফাঁদে পা দিয়ে নিজের অজান্তেই দেশের গোপনীয় তথ্য হস্তান্তর করেছিলেন। তিনি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে এক নারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন এবং ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কের মায়াজালে জড়িয়ে পড়েন। সেই সূত্রেই দেশের গোপন তথ্য চলে যায় শত্রু রাষ্ট্রের হাতে।
আধুনিক হানি ট্র্যাপের আরেক উদাহরণ

আরও এক আলোচিত ঘটনা হলো টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপের প্রতিষ্ঠাতা ও CEO পাভেল দুরভকে ঘিরে। কিছুদিন আগে ফ্রান্সে ব্যক্তিগত বিমানযোগে পৌঁছানোর পরপরই তাকে গ্রেফতার করে ফ্রান্সের পুলিশ। অভিযোগ ছিল, তিনি রাশিয়ার কাছে এনক্রিপ্টেড ডেটা দিতে অস্বীকার করেছিলেন, এছাড়া টেলিগ্রাম প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অপরাধমূলক কাজকর্ম চালানো হচ্ছিল বলে অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
পাভেলের সঙ্গে ছিল এক তরুণী—জুলি নামের একজন ক্রিপ্টোকারেন্সি বিশেষজ্ঞ, যিনি দুবাইতে কাজ করতেন। ইনস্টাগ্রামে পাভেল ও জুলির একসাথে কাটানো মুহূর্তের অনেক ছবি পাওয়া যায়, যা দেখে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ইঙ্গিত মেলে। কিন্তু পাভেলের গ্রেফতার হওয়ার পর জুলি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যান। তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, জুলিকে পরিকল্পিতভাবে হানি ট্র্যাপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল পাভেলের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরেই এই সম্পর্ক সাজানো হচ্ছিল, যাতে একদিন তা কার্যকরভাবে কাজে লাগে। আবার কেউ কেউ বলছেন, জুলি হয়তো নিজের অজান্তেই এই ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসাবধানতাবশত পোস্ট করে ফেলেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
তবে জুলির আচমকা গায়েব হয়ে যাওয়াটাই সন্দেহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—জুলিকে কোথায় নেওয়া হলো? কারা তাঁকে সহায়তা করল হাওয়া হয়ে যেতে?
এই প্রশ্নগুলোর পেছনে লুকিয়ে আছে গোয়েন্দা সংস্থার সেই অদৃশ্য ছায়া, যারা প্রয়োজন বুঝে কাউকে সামনে নিয়ে আসে, আবার প্রয়োজন ফুরোলেই অদৃশ্য করে দেয়। জুলিকে ঘিরে গড়ে ওঠা রহস্যের কুয়াশা আরও ঘনীভূত হয়েছে তখনই, যখন তাঁর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সব পোস্ট হঠাৎ করে ডিঅ্যাকটিভ বা মুছে যেতে থাকে। ইনস্টাগ্রামে একসময় যেসব রোমান্টিক মুহূর্ত শেয়ার করা হয়েছিল, সেগুলো একে একে হারিয়ে যেতে থাকে। জুলিকে কেউ খুঁজে পায়নি তাঁর পরিবারের মধ্যে, সহকর্মীদের মধ্যেও নেই তাঁর কোনো হদিস। যেন পরিকল্পিতভাবে একদিনে মুছে গেছে তাঁর অস্তিত্ব।
এতেই প্রশ্ন জোরালো হয়েছে—জুলি কি আসলেই একজন সাধারণ প্রেমিকা ছিলেন? নাকি শুরু থেকেই তিনি একজন প্রশিক্ষিত স্পাই ছিলেন যিনি পাভেলের জীবন ও তথ্যভাণ্ডারে প্রবেশ করার বিশেষ মিশনে নিয়োজিত ছিলেন? যদি তিনি একজন গোয়েন্দা হন, তাহলে তাঁর এই হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া স্পষ্টতই একটি ‘এক্সট্রাকশন অপারেশন’-এর অংশ হতে পারে—যেখানে লক্ষ্যপূরণ শেষে তাকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়।
আর যদি তিনি সাধারণ কেউ হয়ে থাকেন, তবে প্রশ্ন আরও ভয়ানক: এত পরিকল্পিতভাবে একজন মানুষকে উধাও করে দেওয়া হলো কীভাবে? আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো বা মানবাধিকার সংস্থা কোথায় তখন?
বিশ্লেষকদের মতে, হানি ট্র্যাপ শুধুই একটি মানসিক খেলা নয়, এটি তথ্য, বিশ্বাস ও নিরাপত্তার সবচেয়ে দুর্বোধ্য যুদ্ধক্ষেত্র। আর সেখানে জুলি ও পাভেলের ঘটনা যেন বাস্তব জীবনের একেবারে সাম্প্রতিক, উচ্চমাত্রার ‘সাইলেন্ট অপারেশন’-এর নিদর্শন।