হালাল শব্দের আড়ালে বাণিজ্য!
আমরা এমন একটি সময়ে বাস করছি, যেখানে ‘হালাল’ শব্দটি যেন হয়ে উঠেছে এক ধরনের মার্কেটিং টুল। আপনি কি কখনো চিন্তা করে দেখেছেন, হালাল শব্দটা শুনলেই কেন আমরা স্বস্তি পাই? রেস্টুরেন্টে “হালাল” লেখা দেখলে সেখানে খেতে ঢুকে যাই, বা গ্রোসারি দোকানে কোনও প্রোডাক্টে “হালাল” ট্যাগ দেখলেই সেটা ঝুড়িতে তুলে ফেলি—এই অভ্যাস কি আমরা কখনো যাচাই করি?
এই লেখার উদ্দেশ্য মোটেও কাউকে হালাল জীবনযাপন থেকে বিরত করা নয়, বরং এই শব্দটির আড়ালে যে বাণিজ্যিক ছলনা ও প্রতারণা লুকিয়ে আছে, তা উন্মোচন করা।
হালাল: ধর্মীয় শব্দ, ব্যবসায়িক ব্যবহার

"হালাল" একটি আরবি শব্দ যার অর্থ—ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ। এই শব্দটি শুধু খাদ্য নয়; পোশাক, ব্যাংকিং, কসমেটিকস, এমনকি সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে “হালাল রিলেশনশিপ” নামেও ধারণা বাজারে এসেছে। এমনকি বহু দেশে হালাল ব্যাংকিং, হালাল ট্যুরিজম, হালাল কসমেটিকস ইত্যাদি নিয়ে বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত বছর সারা বিশ্বে হালাল প্রোডাক্ট ও সার্ভিসের বাজার ছিল প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। এই অঙ্কটি ইতালির মোট জিডিপির সমান এবং গোটা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির চেয়ে দ্বিগুণ। হালাল সার্ভিস—যেমন ইসলামিক ব্যাংকিং ও ফিনান্স—এর বাজার মূল্য ২.৮ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা যুক্তরাজ্যের মোট জিডিপিরও বেশি।
হালাল শব্দের পেছনে বিশ্ববাজার
এই ‘হালাল ইন্ডাস্ট্রি’ এত বড় যে এমনকি Tesla যেটা সারা বছরে যত ব্যবসা করে, তার থেকেও দ্বিগুণ লাভ করছে এই হালাল ট্যাগধারী পণ্য ও সার্ভিস কোম্পানিগুলো।
শুধু মুসলিম দেশেই নয়, আমেরিকার মতো দেশে যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ১%, সেখানেও হালাল মার্কেটের পরিধি ৮.১ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যেই এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। জার্মানিতে হালাল ব্যবসা ইতিমধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সুইডেন, নরওয়ে, কানাডা, ফ্রান্সেও এর প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে।
দেশ/কোম্পানি | মুসলিম জনসংখ্যা | হালাল মার্কেট ভ্যালু (প্রায়) | মন্তব্য |
---|---|---|---|
যুক্তরাষ্ট্র | ~১% | $8.1 বিলিয়ন | ২০২৫ সালে $12 বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে |
জার্মানি | ~৬% | $5+ বিলিয়ন | ইউরোপে অন্যতম বৃহৎ হালাল বাজার |
সুইডেন | ~৮% | $5+ বিলিয়ন | হালাল পণ্যের চাহিদা ক্রমবর্ধমান |
মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা
মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় হালাল মার্কেট রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। এরপর তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরান, মিশর, বাংলাদেশ, সৌদি আরব। তবে হালাল ব্র্যান্ডিংকে সবচেয়ে সফলভাবে ক্যাপিটালাইজ করতে পেরেছে মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, জর্ডান ইত্যাদি দেশ।
বিগত বছরের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে বর্তমানে ১৮% ব্যবসা হালাল ট্যাগে চলে, এবং আগামী বছরে এটি বেড়ে ২৪% পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—সবকিছু কি সত্যিই হালাল?
এত হালাল ট্যাগের পণ্য ও সার্ভিসের মধ্যে আপনি আসলেই কি সব হালাল পাচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা নজর দিই হালাল মাংস বাজারের দিকে।
বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ২০০ মিলিয়নের বেশি প্রাণী হত্যা করা হয় খাওয়ার উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে শুধু আমেরিকাতেই মারা হয় ২৫ মিলিয়নেরও বেশি প্রাণী। অথচ ইসলাম অনুযায়ী হালাল জবাইয়ের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে:
- পশুকে কাবা মুখী করে জবাই করতে হবে
- অ্যানাস্থেশিয়া ব্যবহার নিষিদ্ধ
- পুরোপুরি প্রাণ না যাওয়া পর্যন্ত পশুকে কোনো আঘাত করা যাবে না
- জবাইকারীকে মুসলিম হতে হবে
- দোয়া পাঠ আবশ্যক
তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে এই নিয়মের কোনোটিই মানা হয় না। তারা ক্যাপটিভ বোল্ট পিস্তল, ইলেকট্রিসিটি বা কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করে পশু হত্যা করে—যা ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
সবচেয়ে বড় প্রতারণা: হালাল নামের হারাম মাংস
বিশ্বের সবচেয়ে বড় হালাল মাংস রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে ব্রাজিল—যেটি মুসলিম দেশ নয়। শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারকের তালিকায় একটিও ইসলামিক দেশ নেই। ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ফ্রান্স, চীন, সুদান, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, সোমালিয়া, তুরস্ক—এসব দেশ থেকে যেসব মাংস আসে তার উৎপাদন প্রক্রিয়া কতটা হালাল, তা খতিয়ে দেখার কেউ নেই। অথচ আমরা শুধুমাত্র "হালাল" ট্যাগ দেখে সেই পণ্য ভরসার সাথে কিনে খাই।